Header Ads

Header ADS

করল্লা

চলন্ত বাসে সামিয়া বললো, অ্যাই বাস টা থামাও তাড়াতাড়ি!
এমন ভাবে বললো মনে হচ্ছে সে পেট নামার রোগী। আমি তাঁকে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছি, সে বললো আর আমি থামিয়ে ফেললাম! ওর চোখ মুখ দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, আমি যা ভাবছি তা না তো আবার?
ও কেমন মোচড় দিয়ে বললো, যা ভাবছো তা ই। প্লীজ যেভাবে ই হোক বাস থামাও, নাহলে কিন্তু! 
কী ঝামেলায় পরলাম! ওর একটাই বাজে অভ্যাস, যেখানে সেখানে এক আসে। মাঝে মাঝে এক আর দুই একসাথে আসে। বাস চালককে তো আর এই কথা বলতে পারবো না, গিয়ে বললাম, ভাই আমার আর ঐ মেয়েটার ব্যাগে বোম আছে! বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন বিস্ফোরণের জন্য! 
বাস চালক বিশ্বাস করলো না। সামিয়া এর মধ্যে চাপ ধরে না রাখতে পেরে নাচানাচি শুরু করে দিলো। যে কারণে সবাই আমার কথা বিশ্বাস করে নিলো এবং চিৎকার করতে লাগলো। সবার অনুরোধে বাস থামানো হলো। 
সাথে সাথে আমি আর সামিয়া নেমে এক দৌড়! আমাদের দৌড় দেখে সবাই বুঝে ফেলেছে যে আমরা মিথ্যা বলেছি! এর পরে যদি কোনোদিন আমাদেরকে এদের মধ্যে কেউ পায়, তাহলে নিশ্চিত পুলিশে দিবে! 
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দম নিয়ে বললাম, আশেপাশে কোনো টয়লেট পাবে না। জঙ্গল আছে দেখো এইযে। তাড়াতাড়ি জঙ্গল থেকে কাজ সেরে আসো।
এই কথা শুনে ও এমনভাবে চোখ ঘুরালো মনে হচ্ছে আমি এলিয়েন! বললো, জঙ্গলে যাবো কেনো? মতলব তো ভালো না তোমার!
আমি ঝারি দিয়ে বললাম, তুমি না বাসে বললা আমি যা ভাবছি তা ই। তাহলে যাও, এখন আবার আমার মতলবের কী দেখলে? 
ও কোমরে হাত দিয়ে বললো, জ্বী না! আমার ওসব কিছু হয়নি। বাসে সুন্দরী অনেক আপু ছিলো, আর আপনি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন তাঁদের দিকে। আমার সহ্য হয়নি। তাই আপনাকে নিয়ে নেমে গেছি! 
মন চাচ্ছে ওর গালে কষে একটা থাপ্পড় মারি! দাঁত কামড়িয়ে বললাম, এখন আমাদের দশ মাইল হাঁটতে হবে! দশ মাইল বুঝো? নিজে তো আধ মাইল ও হাঁটতে পারো না। আজকে এখানেই রাত পোহাবে! 
ও হেসে উড়িয়ে দিলো আমার কথা। ভেবেছে এই রাস্তায় ঠিক গাড়ি পেয়ে যাবে, কিন্তু আধঘণ্টা পরপর একটা করে বাস আসে, তবে থামে না। স্টেশন আরো দশ মাইল কমপক্ষে! এক মাইল হাঁটার পরে ও বসে পরে বললো, শব্দ, তোমার পায়ে ব্যথা লাগে না? আমি তো আর পারছি না। 
আমি বললাম, আবার বলো না, শব্দ আমাকে কোলে নাও প্লীজ। আমি শাহরুখ খান না, না কোনো সিনেমার নায়ক। আমার গায়ে এতো জোর নাই। 
ও অসহায়ের মতো বললো, মনের কথা বুঝে গেছো। প্লীজ আমাকে কোলে করে নিয়ে হাঁটো। তোমাকে আমি কালকে করল্লার ভাজি খাওয়াবো রান্না করে। প্লীজ নাও না!
এমনভাবে বলে, এড়িয়ে যেতে পারি না ওর কথাগুলো। কিন্তু রাগে শরীর ও ফাটছে। পাঁচ মিনিটের বেশি কোলে নিয়ে হাঁটতে পারবো না জেনে ও কোলে নিলাম। ও যেন পাঁচ তারকা হোটেলের বিছানায় শুয়ে আছে!
আরামছে চোখ বুঝে ঘুমাচ্ছে মনে হচ্ছে! এদিকে দুই মণের বস্তা টানতে টানতে আমার অবস্থা শেষ! ঝারি দিয়ে বললাম, ঘুমাচ্ছো না কী? পারো টা কী তুমি বলো? প্রত্যেকদিন কোনো না কোনো ঝামেলা বাঁধাবে আর আমাকে তার জন্য খাটতে হবে! আশি কেজি ওজনের হাতি তুমি ও মা গো! 
ও চোখ খুলে বললো, বলছি না করল্লা ভাজি খাওয়াবো তোমাকে? তখন অনেক শক্তি হবে গায়ে। তাছাড়া বারবার ওজনের খোঁটা দিবে না। কালকে ও মাপছি আমি মাত্র পঁয়তাল্লিশ কেজি! 
ওকে কোল থেকে নামিয়ে বলললাম, করল্লার মাঝে তুমি পাইছো টা কী? করল্লার শরবত, করল্লার ভাজি, করল্লা ভর্তা, করল্লার নিরামিষ!
ও ভেঙচি দিয়ে বললো, করল্লার অনেক উপকারিতা আছে, জানো না? আচ্ছা যাও তোমার জন্য স্পেশাল করল্লার বিরিয়ানি রান্না করবো।
আমি দুঃখে কেঁদে দিয়ে বললাম, মানে আর কিছু ছিলো না তোমার রান্নার তালিকায়? শেষে করল্লার বিরিয়ানি? মানুষের জন্য না মহিষের জন্য? 
ও কান্না শুরু করে দিলো! আমার আর ভালো লাগছে না। ওকে পিছনে ফেলে আমি হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে গেলাম। ও আমাকে যত ডাকছে আমি ততো দৌড়ছি! 
শেষমেশ আরো আধমাইল কমপক্ষে মহারাণীকে কোলে করে আনতে হলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বাড়িতে এসে হাত পা ছেড়ে গোসল করলাম। শরীর ক্লান্ত বিধায় বিছানাতে গা হেলানোর সাথে সাথেই চোখে ঘুম এসে গেলো।
এশার আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে দেখি সামিয়ার একশো তেরো টা ফোন! মোবাইল নিঃশব্দ করে রেখেছিলাম তাই টের পাইনি। আবার ফোন বাজতেই আমি ধরে বললাম, বাবা ঘুমাচ্ছি তো, অনেক ক্লান্ত আজকে।
ও ফিসফিস করে বললো, সেজন্যই তো তোমার জন্য আজকে স্পেশাল একটা কিছু আনছি। তুমি নিচে এসে নিয়ে যাও তাড়াতাড়ি!
আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। তবে বিলম্ব হলাম না। আর আগে সে বহুবার আমার জন্য বিশেষ রান্না করে এনে খাইয়েছে লুকিয়ে! এবার একটু কম সময়ে রান্না করে ফেললো মনে হয়! আমি নীচে গিয়ে দেখি ও বোরকা পরে এসেছে!
আমি যাওয়ার সাথে সাথে আমার হাতে টিফিন বাটি ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো হনহন করে! একটা কথা ও বললো না! আমি বাটি নিয়ে দরজা পার হওয়ার সাথে সাথেই মা বললো, আজকে আবার কে আপনার জন্য খাবার পাঠাইছে সাহেব? আনেন আজকে আমি খাবো।
আমি ও কোনো কিছু না বলে মায়ের হাতে বাটি টা দিয়ে দিলাম। মা কিছুক্ষণ পর আমার রুমে দৌড়ে এসে বললো, কে রান্না করছে এগুলা? 
আমি একটু ভাবসাব নিয়ে বললাম, এক বান্ধবী। অনেক ভালো রান্না করে, মজা হইছে না?
মা জিহ্বা বের করে বললো, হ্যাঁ বাবা অনেক মজা হইছে, কাঁচা ভাত আর করল্লার রস ছাড়া কিছুই নাই! আর এমন তিতা করল্লা আমি জীবনে ও খায়নি! 
আমি চুপ হয়ে গেলাম। সামিয়া আজকে ও করল্লা রান্না করলো! মা রুম থেকে যাবার পরেই সামিয়া ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন হইছে রান্না? অনেক মজা হইছে তাই না? এটা হচ্ছে করল্লার ভুনা, আমার নতুন আবিষ্কার! শরীরের জন্য অনেক ভালো।
আমি ঝারি দিয়ে বললাম, মা খাইছে আজকে তোমার স্পেশাল করল্লার ভুনা! আর বলে গেছে এমন পঁচা খাবার সে কোনোদিন খায়নি! করল্লা ছাড়া যদি আর কিছু রান্না করতে পারো তাহলে আমার জন্য আনিয়ো, নাহলে প্লীজ আর আনার দরকার নাই! 
ও, এতো খারাপ হইছে? 
বলে ফোন টা কেটে দিলো। রাগ করেছে নিশ্চিত! আজ সারারাত সে কান্না করবে, আর সকাল হলেই ফোন দিয়ে বলবে, করল্লার নতুন আইটেম পাইছি, রান্না করে আনবো তোমার জন্য? 
কিন্তু না! সকাল হলো আর ও ফোন দিলো না! অবাক হয়ে আমি নিজেই ফোন দিলাম, ওর মা ফোন ধরলো। জানতে পারলাম কাল রাতের পর থেকে এখন পর্যন্ত একবার ও না কী সামিয়া রান্নাঘরে যায়নি!
অথচ সে রান্নাঘরে ই সারাক্ষণ থাকে, সেখানেই ঘুমায়! ওকে কষ্ট দিলে আমি কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারি না। যা ই করতে যাই। ওর বোকা বোকা হাসি চোখের সামনে ভেসে উঠে, তখন ওর গালে ধরে টান দিতে খুব ইচ্ছে হয়। দুদিন পর ও দেখা করতে রাজি হলো।
গিয়ে দেখি ও মুখ গোমড়া করে বসে আছে। যতো যা ই করি, রান্না ব্যতীত এই বালিকার মন ভালো করা যাবে না, না ভাঙ্গানো যাবে রাগ অভিমান। তাই ওর জন্য ডিম ভাজি করে নিয়ে আসলাম।
এছাড়া আর কিছু পারি না, তবে ওর মুখ থেকে করল্লা রান্নার বর্ণনা শুনতে শুনতে করল্লা রান্না শিখে গেছি। ব্যাগ থেকে টিফিন বাটি টা বের করার পর ও মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, আমার রান্না আমার জন্য ফেরত আনছো না? 
আমি মাথা নাড়িয়ে বাটি টা খুললাম, ও ডিম ভাজি দেখে দাঁত বের করে হেসে দিয়ে বললো, আল্লাহ্‌, ডিম ভাজি! আপনাকে আন্টি এখনো ডিম ভাজি করে দেয়?
আমি গালগোল ফুলিয়ে বললাম, না তো, আমার হাতি টা রাগ করছে, তাই ওর জন্য ডিম ভাজি করে আনলাম। আর তো কিছু পারি না।
ও উঠে দাঁড়িয়ে বললো, হাতি? হাতি মানে কী? আমি কী মোটী? থাকেন আপনি, আমি গেলাম। 
আমি মনের বিরোদ্ধে কান ধরে ওকে হাসানোর চেষ্টা করলাম। ও হাসলো না। আমি নিজ হাতে তুলে ওর মুখে ডিম ভাজি দিয়ে ভাত দিলাম, মুখ ফিরিয়ে নিলো! আমি হাত টা ধুয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম, আজ যদি আমার মনের হাতি থাকতো। তাহলে আমার রান্না করা ডিম ভাজি টা ভালোবেসে খেয়ে নিতো। 
আমি আর বলতে পারলাম না, ও আমার গলায় ধরে বললো, হাতি কেনো? উফ, হাতি নিয়েই থাকেন।
ও উঠে চলে গেলো। আমি ডিম ভাজির দিকে তাকিয়ে আছি, ভাজি টা বলছে, যা বাপ, বাড়ি চলে যা। নিজের ভাজি নিজে খা গিয়ে।
কিন্তু না, সামিয়া আবার কোথ থেকে এসে চেয়ারে বসে বললো, খাইয়ে দাও। তবে আমি কিন্তু কারো মনের হাতি হতে পারবো না।
আমি মৃদু হাসি দিয়ে আবার ওর মুখে ভাত তুলতেই ও বললো, এক মিনিট তোমার জন্য একটা স্পেশাল জিনিষ আনছি, তুমি ওটা না খেলে আমি ও খাবো না। 
বলে ব্যাগ থেকে আস্ত একটা করল্লা বের করলো! আমি আর পারলাম না। কেঁদে দিয়ে বললাম, দাও কামড়াই, গরীবের কপালে করল্লা ছাড়া আর কিছু থাকে না!
| করল্লা | 

No comments

Powered by Blogger.